স্ট্যালিন আবার জন্মাল মেদিনীপুরে

হিরণ মিত্র, চিত্রশিল্পী, কলকাতা

 

আমার বাড়িটা ছিল বিচিত্র। একদিকে প্রচণ্ড গোঁড়া, প্রচণ্ড নিয়ম-কানুন। অন্যদিকে হাতি গলে যেত কারও কোন হুঁস নেই। বাড়ির যে মূল সহকারি বৃদ্ধ দশরথ, ওড়িশা থেকে এসেছে। নেশা করত ভীষণ। গুলি বা আফিঙের নেশা। মাহিনা দেওয়ার কোন ব্যবস্থা তখনকার দিনে কারও জন্যই বরাদ্দ ছিল না। আমি দেশের বাড়ি গেলে, কিছু টাকা জুটত ওর। সে গল্প অন্য। সেই দশরথ সুযোগ পেলেই বাড়ির নানা জিনিস, সামনের বাজারে বিক্রি করে দিত।

 

আমার বড়দার ঘরটি ছিল আক্ষরিক ভাবেই যাদুঘর। আশ্চর্য সব জিনিসের দেখা মিলত। ওখানেই ছিল শত বৎসরের প্রতিটা বছরের পঞ্জিকা। বাড়িতে দুর্গাপুজো বা অন্য কিছু হয়। মণ্ডপ আছে। প্রতি বৎসর পঞ্জিকা কেনার রেওয়াজ। গুপ্ত প্রেস বা তেমন কিছু সেই পঞ্জিকা খয়েরি হয়ে যাওয়া শরীর থেকে সাদা এক টুকরো কাগজ উঁকি মারত। আমি আবিষ্কার করি, সেই সাদা টুকরো, পরিবারের এক এক জনের জন্ম তারিখ।

 

 

আমারটা সময় মতো নিয়ে নিয়েছিলাম। কারণ এক সকালে দেখা যায় সমস্ত পঞ্জিকা উধাও। সের দরে দশরথ তা পাচার করেছে। তার সঙ্গে চলে গেল সবার জন্মদিন। দাঁড়ি পাল্লায় ওজন হয়ে গেল মাস-বৎসর-দিন। কারও কোন শোক হল না। কারণ আমাদের বাড়িতে কোনদিন জন্মদিন পালন হয়নি। তাই জানার দরকার পড়েনি। শত বৎসরের পঞ্জিকা শুধু জন্মদিন জানাত না, একটা সংস্কৃতির প্রতীক ছিল। তার বিজ্ঞাপন, তার গণনা, ভুল বা ঠিক সময়ের সরণি বলা যায়। যেমন একদিন দেখলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা ছাদের ঘর ধুলো মাখা।

 

অজস্র আবর্জনা স্তূপাকার তার মধ্যে ছোট্ট গোল একটা কাঠের চাকতির মাথায় লোহার শলাকা উঠে গেছে। তার শেষ প্রান্তে বেশ সূঁচালো ও ধারালো। বেশ হাত দেড়েক লম্বা সেই কালো তারটি। এই ধরণের জিনিস পুরনো বাড়িতে দেখা যেত। এর ব্যবহারটিও আশ্চর্য রকমের। যত চিঠি, রসিদ, মেমো, নোটিশ সব গাঁথা থাকত ওই লোহার তারের মধ্যে থাকে থাকে। গাছের মতো চেহারা নিত।

 

আমি সেই ফেলে দেওয়া শত বৎসরের পুরনো পোস্ট কার্ড উদ্ধার করলাম। কী অপূর্ব হাতের লেখা! সামান্য জায়গাও নষ্ট করা হয় নি। ঠাসা বুনোনে লেখা। পারিবারিক কথা, জরুরি কথা, খবর বিনিময়। ওগুলো উত্তরপাড়ার এক সংগ্রহ শালায় দিলাম। আমার মায়ের স্নেহ-ভরা চিঠিও ছিল। যেন স্বয়ং মা সামনে বসে আছেন। তাও দিয়েছি। মা-তো রয়ে গেলেন। আমাদের বাস্তুবাড়ি যখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে, একটা বিশাল সিন্দুক আবিষ্কার হয়। লোহার সিন্দুক আর তার চাবিটিও দেখবার মতো ছিল। মা ডেকে পাঠালেন। তুই যা পারিস তুলে নিয়ে যা। কেউ এগুলোর যত্ন করবে না। আজও তারা আমার ঘরের আনাচে কানাচে উঁকি মারে। আমার সঙ্গে আলাপ করে। কুশলও শুধায়। মা মুচকি মুচকি হাসে।

 

বাড়িটা ঠিক সেই অর্থে আজব চিড়িয়াখানা। মেজদার জন্তু-জানোয়ারের শখ। টিয়া, কাকাতুয়া, ময়না, বুলবুলি, হাঁস-মুরগি তো সাধারণ ব্যাপার। একটা গাছে ছিল একটা ময়ূর। মাধবীলতার ব্যাঁকানো ডালে সে বসত। গাছটার নাম হয়ে গেল "ময়ূর গাছ"। আস্তাবলে একটা টাট্টু ঘোড়া ছিল। ছোড়দা ও আমি কতবার পড়ে গেছি ওর দুষ্টুমিতে। ছোট জন্তুর মধ্যে খড়গোশ, গিনিপিগ এছাড়া পোষা নয় কিন্তু অবাধ বিচরণ ছিল সাপেদের।

 

বিষধর সাপ। বাস্তু সাপ। একটা গোখরো এমন বড়ো, আমি ভাবতাম কিং কোবরা। পরে শুনেছি মেদিনীপুরে নাকি কিং কোবরা দেখা যায় না। বলা হয়নি, আমার বাড়ি খড়গপুর শহরের একপ্রান্তে খরিদা অঞ্চলে ছিল। প্রচুর নিম গাছ থাকার জন্য আরেক নাম ছিল "নিম গেড়িয়া পাটনা"। এ পাটনা সে পাটনা নয়। "খরিদা" নামের উৎপত্তি জানি না। তবে আমাদের বাড়ির চারিদিকে বাজার বসত। সে কাহিনিও লম্বা। পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। খরিদ করা বা কেনা থেকে "খরিদা" হয়ত।

 

বাড়িটা কোলাহল মুখর। আমরা ছিলাম আট ভাই-বোন জীবিত। এই জীবিত কথার অর্থ আসলে ছিলাম চোদ্দজন। আমার জন্মের পর ডেথরেট বন্ধ হয়। মানে আগে বছর বছর ছেলে-মেয়ে মারা যেত।  তাঁদের মৃত্যুর করুণ কাহিনিও বড়ো মন ভারি করার। আজ নাই বা বললাম। আমার বড়দা মারা যান ছাপান্ন বছরে। দুর্ঘটনায়। মেজদা, সেজদা, ছোড়দা প্রায় নব্বই-এর কোটায়। ছোড়দি যায় সত্তরের কোটায়। আমি আর দুই দিদি বর্তমান। মার জন্ম ১৯০০ সালে, অনুমান। বাবার ১৮৯০ অনুমান। সেই অনুমান আমারই। তারও বিচিত্র এক অঙ্ক আছে।

 

বাড়িটা রাজনীতির। বাবা হিন্দু মহাসভায় বিশ্বাসী। সেজদা, ছোড়দা, ছোড়দি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্তে বিশ্বাসী। তার কাহিনিও লম্বা। বেশ রোমহর্ষক। সেজদা আমার নাম রাখে ‘স্ট্যালিন’ ১৯৪৫, ডিসেম্বরে। আমার জন্ম জুলাইতে। স্ট্যালিন তখন লৌহমানব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। নাৎসি বাহিনি পরাস্ত। স্ট্যালিন আবার জন্মাল মেদিনীপুরে।

বাড়িতে পুজো মণ্ডপ। পাড়াতে একটা বারোয়ারি দুর্গাপুজো হত। কোন মত বিরোধে বন্ধ হলে, বাবা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। আগে নাকি ঘটপুজোর রেওয়াজ ছিল। মণ্ডপ তৈরি হল ১৯৩৪ সালে। লোহা-কাঠ দিয়ে বিশাল এক কাঠামো বানানো হত। কথিত আছে, পুরীর রথের ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে ঐ কাঠামো বানানো এবং ওড়িশার কাঠ মিস্ত্রি এসে এটা বানায়। বেশ সরেস গল্প। যাই হোক আজও সেই কাঠামো বর্তমান। বছর বছর তাকে সামনের পুকুরে ভাসান দেওয়া হয়। লোহার চেন দিয়ে বেঁধে রাখা আর পরের ভোরে তুলে আনা। জল ঝরতে ঝরতে সে আসত, আজও আসে। ভাসানের আগে সমস্ত খড়গপুর শহরটা প্রদক্ষিণ করে। তার কাহিনিও আমি এঁকে রেখেছি। দৌড়ে দৌড়ে আঁকা সেই সব ধারাবাহিক লেখাচিত্র আজও রক্ষিত।

 

যে প্রসঙ্গে এই পুজোর কথা এল, তা হল যাত্রা-পালা। সেই ক'দিন নানা গান অনুষ্ঠান, যাত্রা হত। তারা এসে আমাদের বাড়িতে থাকত। একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন সেই দলে। প্রতি বছরই আসতেন তারা। কবে বন্ধ করলেন, কেন করলেন আমার জানার সুযোগ হয়নি। সেই চিত্রশিল্পীর নাম কেউ লিখে রাখেনি। তার একটি শিল্পকর্ম আমার সংগ্রহে রয়েছে এইটুকুই বলার।

 

এই থেকে আমার যাত্রা, নাচ, নাটক, পালায় আগ্রহ এল। পাড়ায় শুরু করলাম নাটক। কিশোর ও ছোট বয়সের পাগলামো। কত মজার কাণ্ড যে ঘটিয়েছি! ম্যারাপ বেঁধে হ্যাজাক জ্বেলে নাটক হত। তার মঞ্চ-পোশাক, মেকআপ সবই আমার দায়িত্বে। বেশ কিছু অভিনেতা, অভিনেত্রী ছোট ছোট থাকাতে আর কিছু বড়দের প্রশ্রয়ে বেশ জমে ওঠে আমাদের স্কুল  জীবন। একদিন সব ভেঙে গেল। বিদায় জানালাম। পুরনো পাড়াকে। পুরনো বন্ধুদের। সেই অসাধারণ কিশোর বয়স পিছনে পড়ে রইল। অজানার নগরে পাড়ি। কোলকাতা আর্ট কলেজ।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...