জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ইলিশের সুবাস

‘মাছের মধ্যে রুই
শাকের মধ্যে পুঁই
ডালের মধ্যে মুসুরি
মানুষের মধ্যে শাশুড়ি।‘

ছোটবেলায় এই ছড়াটা আমার ঠাকুরদার মুখে বহুবার শুনেছিলাম। সম্ভবত পূর্ববঙ্গে এই ছড়ার প্রচলন ছিল। তবে ছড়ায় যতই রুই মাছের উল্লেখ থাকুক বা রুই মাছকে যতই ‘মাছের রাজা’ বলে সম্বোধন করা হোক না কেন, ‘জলের রানি’ কিন্তু সেই ইলিশ। ইলিশ মাছ ভাপা, ভাজা, ইলিশের ঝোল, ঝাল, টক সবই যেন অমৃত সমান। ইলিশ মাছ রান্নায় এতটাই বৈচিত্র্য রয়েছে যে বলা হয়, ইলিশ মাছের প্রায় পঞ্চাশ রকম পদ আছে। ইলিশ মাছই কি শুধু সুস্বাদু? তার ডিমের স্বাদও অতুলনীয়। আমার বাবা বাজার থেকে মাছের ডিম আনলে মজা করে বলেন, ‘মাছের বংশধর নিয়ে এলাম’। ইলিশ মাছ রান্নার সময় খুবই সামান্য তেলের ব্যবহার করা আবশ্যক। এই মাছ রান্নার সময় এর শরীর থেকে যে পরিমাণ তেল নির্গত হয় তাতে অনায়াসে মাছ ভাজা হয়ে যায়। ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’ এই প্রবাদ বাক্যটি বোধহয় এই মাছটির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

bengali Ilish Parbon

এই ইলিশ মাছ নিয়ে আমাদের পরিবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন ঘটনা। আমার ঠাকুরদার কথাই প্রথমে বলি। এরকম ভোজনরসিক বাঙালি আমি খুব কমই দেখেছি। তাঁর যুবক বয়সে তিনি যে কী ভাবে মাছ আর মিষ্টি খাওয়ার প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন মানুষজনকে হারিয়ে দিতে পারতেন সেসব গল্প বহুবার তাঁর মুখেই শোনা। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মানুষ হওয়ায় পদ্মার ইলিশের স্বাদ তাঁর মুখে লেগে ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ইলিশ ছিল তাঁর সবচেয়ে প্ৰিয় মাছ, তাই প্রতিবছরই বাজারে ইলিশ উঠলে আমাদের বাড়িতে অনেকদিনই আসত। দাদুর দেখাদেখি আমারও ইলিশ মাছ খেতে শেখা এবং পছন্দ করতে শুরু করা। আমার দাদু মারা যান ২০০৫-এর ৭ অগস্ট। তবে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে শ্রাদ্ধের দিন। তাঁর ভাতসরাতে দেওয়ার জন্য ঐ বছর ঐ সময়ে একটা ছোট্টো ইলিশ মাছ আর অল্প কচুর শাক পাওয়া গিয়েছিল। তারপর ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক এবং ইলিশের অন্যান্য কিছু পদ রেঁধে ভাতসরায় দেওয়া হয়। সেদিন যে কীভাবে ঐ ছোটো মাপের ইলিশ মাছ পাওয়া গিয়েছিল তা আজও আমাদের কাছে একটা বিস্ময়। আমরা অনেক কিছুই বিশ্বাস করি না, বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে মন চায় না কিন্তু আমাদের যুক্তির বাইরে যে কতকিছু থাকে সেকথা নিজেরাই বুঝতে পারি না। তবে একথা ঠিক যে, দাদুর মৃত্যুর পরে বেশ কয়েক বছর আমি ইলিশ মাছ খেতে পারিনি। ঐ আকস্মিক ঘটনায় মাছটার প্রতি অদ্ভুত অভক্তি এসে গিয়েছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার সব ঠিক হয়।

এবারে আমার দিদিমার কথায় আসি। তিনিও ইলিশ মাছ খুবই ভালোবাসতেন। ২০১৭ সালের ইলিশের মরসুমে আমাদের বাড়িতে অনেক ইলিশ মাছ আনা হয় এবং তৃপ্তি করে খাওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৮ এর জানুয়ারি মাসে দিদিমার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ৩ জুন তিনি চলে যান। মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে ইলিশ মাছ খাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মে মাসে সাধারণত ইলিশ পাওয়া যায় না কিন্তু সেদিন পাওয়া গিয়েছিল। সেই মাছটার মতো সুস্বাদু মাছ আমরা আর কখনো খাইনি! ঐ অসুস্থতার মধ্যেও জোর করে মাছ মুখে দেন কারণ উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সেদিন তিনি না খেলে আমরা আর কোনোদিনই ঐ মাছ মুখে তুলতে পারব না। কথায় বলে, মানুষ এখান থেকে যা নেয় তা এখানেই রেখে যায়। দিদিমা মারা যাওয়ার আগে কষ্ট করে খাওয়া সমস্ত মাছটাই উগরে দিয়েছিলেন কারণ তখন আর সেসব পরিপাক হওয়ার পরিস্থিতিই ছিল না। এখনো বাড়িতে ইলিশ মাছ এলে এই ঘটনাগুলোর উল্লেখ করা হয়। এভাবেই ‘রূপালি ফসল’ আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।


লেখক পরিচিতি:

সবর্ণা ব্রহ্মচারীর জন্ম ১৯৯৩ সালের ৮ই জুন, দক্ষিণ কলকাতায়। লেখিকা বর্তমানে পেশায় স্কুলশিক্ষিকা, পাশাপাশি কিছু ম্যাগাজিন এবং সংকলন সংখ্যায় তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত মুখপুস্তিকায় (ফেসবুক) লেখালেখি করার পরে ২০২৪ এর কলকাতা বইমেলায় তাঁর প্রথম একক গল্প সংকলন 'পঞ্চভূতেষু' প্রকাশিত হয়েছে 'আগন্তুক প্রকাশনীর' হাত ধরে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...