শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন–
‘‘জেলেরা ইলিশ মারে মারুক
কাছে এসে দরদাম পারুক।
এক হালি দুশো বিশ বলে
দরদাম তবুও তো চলে।
আমরা স্টিমারে বসে দেখি
নৌকার মাছ ফুরালো কি?’’
বাঙালির নামের সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে ‘মাছ ভাতে বাঙালি। বাঙালির পাতে মাছ আর সেই মাছের মধ্যে ইলিশের সম্পর্ক অনেকটা ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্কের মতো। বাঙালির ইলিশ প্রেম আদি, অকৃত্রিম, চিরন্তন। ইলিশের পেটি, গাদা, ল্যাজা, মুড়ো, তেল, কানকো, কাঁটা, ডিম…কোনও কিছুই যেন ছাড়া যায় না! ঝোল, ঝাল, তেল, অম্বল– যেমন ভাবেই খাও এবং খাওয়াও, সবেতেই সুখ! আমাদের কাছে ইলিশ আর শুধুমাত্র একটা মাছে আটকে নেই! সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে!
বাঙালি অনুষ্ঠান বাড়িতে, সে যা হোক না কেন জন্মদিন, বিয়ে, এমনকি জামাই-আপ্যায়ন, সবকিছুতেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে এই ইলিশ, আর ইলিশের পরিমাণের উপর নির্ভর করে বাড়ির সম্মান। ধরুন পাঁচু কাকু বাজারে গিয়ে একটা বড় দেখে ইলিশ মাছ কিনেছে। আর সেটা রাস্তা দিয়ে আনার সময় পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে থাকা রামু, সন্টু, হেলা আর ফেলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে এই দেখেছিস কত বড় ইলিশ নিয়ে যাচ্ছি, আজ বাড়িতে জামাই আসবে!
বাঙালির ইলিশপ্রীতি থেকে বাদ যায়নি খেলা। যেমন ইলিশ মার্কা ইস্টবেঙ্গল আর চিংড়ি মার্কা মোহনবাগানের মধ্যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাঙাল-ঘটির ফুটবলের লড়াই, বাঙালি সংস্কৃতিতে অন্যতম মাত্রা যোগ করেছে।
ইলিশ হলো মাছের রাজা, ইলিশ হলো রানী
পদ্মা নদীর ইলিশ মানে, জিভের ডগার পানি!
ইলিশ মাছের দো-পেয়াজ, ইলিশ মাছের ঝোল
সর্ষে ইলিশ খেয়ে প্রাণে, বাজে সুখের ঢোল।
বাঙালির অতি প্রিয় ইলিশের নানা রকম নাম রয়েছে, নানা নামে নানান জায়গায় ইলিশ পরিচিত- গঙ্গা, রূপনারায়ণ, ব্রহ্মপুত্র, গোদাবরী, নর্মদা, তাপ্তী, পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কর্ণফুলি, ইরাবতী সবেতেই সাগর উজিয়ে ইলিশ আসে। গঙ্গা,পদ্মা উজিয়ে যে ইলিশ আসে, তাকে ইলিশ বললেও অন্য নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলে, তার আর ইলিশ নাম থাকে না। সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পঞ্চতন্ত্র’– এ লিখছেন, নর্মদা উজিয়ে যে ইলিশ আসে, ভৃগুকচ্ছের মানুষের কাছে তা ‘মদার’ নামে পরিচিত। পার্সিদের কাছে তার নাম ‘বিম’। সিন্ধু নদের ওই মাছের নাম ‘পাল্লা’। তামিলরা ইলিশকে বলে ‘উলম’। গুজরাতিরা পুরুষ ইলিশকে বলে ‘পালভো’, স্ত্রী ইলিশকে বলে ‘মোদেন’। তাছাড়াও ইলিশের আরও অনেক নাম আছে, খয়রা ইলিশ, গৌরী ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, গুর্তা ইলিশ, সকড়ি ইলিশ, জাটকা ইলিশ, ফ্যাসা ইলিশ, খ্যাপতা ইলিশ, মুখপোড়া ইলিশ এমন নানা রকম...! বাংলাদেশে যে ইলিশ বিলে পাওয়া যায়, তাকে বলা হয়ে থাকে ‘বিলিশ’। একসময় গঙ্গায় খুব ভালো মানের ইলিশ পাওয়া যেত এবং সেই ইলিশ ফেরি করত মাছওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় হাঁক পাড়ত পদ্মার ইলিশ! গঙ্গার ইলিশ! এইভাবে….
এখন সময় বদলেছে। গঙ্গায় ব্যাপক পরিমাণে দূষণ বাড়ায় আর সেই ইলিশ চোখে পড়ে না আর পড়লেও দাম থাকে আকাশ ছোঁয়া কিন্তু বাঙালির পাতে ইলিশ পৌঁছবে না তা সম্ভব নয়। বাঙালি এবং ইলিশ যেন এক সমানুপাতিক সম্পর্ক।
কলমে: হিমাংশু দাস
পরিচয়: লেখক শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন প্রকৌশলী কিন্তু সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি এক প্রকাশনার সহ প্রতিষ্ঠাতা। অবসর সময়ে লেখালেখি করেন।