শীত পড়তেই পিকনিকের ধুম, এই ডিসেম্বর'র শুরুতে অবশ্য ওয়ার্ম আপ চলছে এখন. স্কুল কলেজ শুধু ছুটি হবার অপেক্ষা ! এই হাওয়ায় আমরাও তো আছি. তবে গতানুগতিক পিকনিকের বাইরে একটা দিন ছুটি যোগ করে এবার এক extended picnic'এর হদিশ সবুজ পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ জলাধার আর হারিয়ে যাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস। এই দুয়ের মেলবন্ধনে এক জমজমাট প্যাকেজ । শুক্রবার বেশী রাতের ট্রেনে শহর ছেড়ে আবার রবিবার কাক ভোরে রিটার্ন ব্যাক। চল যাই....
পুরুলিয়া জংশন. এটাই এই সফরের connecting station. সবচেয়ে সুবিধের ট্রেন চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার. শুক্রবার কাজের পাট চুকিয়ে আরামসে ধরা যাবে. হাওড়া থেকে রাত 11.05'এ ছেড়ে পুরুলিয়া জংশন পৌঁছুচ্ছে ভোর 6.20. ছোট্ট উইক এন্ড ছুটি'তে কোনো সময় নষ্ট নেই ! এক ঘুমেই রাত কাবার, সাত সকালেই পুরুলিয়া পৌছে গেলাম । সারা দিনটাই হাতে, রিটায়ারিং রুমে ধীরে সুস্থে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া. স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়েই কয়েক কদম এগিয়ে ছোট্ট এক চানা-বাটুরা স্টল. এই সাত সকালেই লাইন লেগে আছে. জম্পেশ এক ব্রেকফাস্ট. কনকনে শীতের ভোরে একবারের জায়গায় না হয় দু' কাপ চা ! এবার তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক। আগে থেকে ঠিক করা গাড়ী স্টেশন চত্বর থেকেই pick up করবে. দুগ্গা দুগ্গা ।
আমার এবারের সফর সারথি - কৈলাশ. ভূমিপুত্র এখানকার. পুরুলিয়া'র চেনা অচেনা সব জায়গাই ওর নখ দর্পনে।
সক্কাল সক্কাল সোনা রোদ গায়ে মেখে এক ঐতিহাসিক অভিযান ! হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস খুঁজতে প্রথম স্টপ : দেউলঘাটা - Land of Temples. শহর পুরুলিয়া থেকে 33 km. দূরত্বে, গাড়িতে ঘন্টা খানেকেই পৌঁছে যাওয়া।
দেউলঘাটা'য় পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে কংসাবতী. কেউ কোত্থাও নেই , আস্ত একটা নদী যেন নিজের ! দারুন কিছুক্ষন সময় কাটবে এখানে। স্থানীয়'দের আদরের কাঁসাই, কত যে ইতিহাসের সাক্ষী। পৌষ সংক্রান্তি'তে টুসু ভাসানের বড় মেলা বসে এখানে।
দেউলঘাটায় সবুজে ঘেরা জীবন্ত ইতিহাস, একাদশ শতকে পাল-সেন যুগে তৈরি হওয়া Rekh Deul, Majestic Deulghata. কি অপরূপ শিল্পকীর্তি। এখন অবশিষ্ট 2'টি দেউলের একটি, নামেই সংরক্ষন, আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া'র লোকজন শেষ কাজে হাত দিয়েছিলো নাকি 10 বছর আগে । দেউলঘাটা'র ভগ্নস্তূপে এককালের পুজোর স্থান, দেউলঘাটায় ঢুকতেই প্রথম দেউল'টির খোদাই শিল্প, দেউলঘাটা'র অপর দেউল।
ইতিহাসের আঙিনা ছেড়ে আবার পথে. এই সবুজে ঢাকা স্বপ্ন মাখা পথ ধরেই বেগুনকোদর হয়ে মুরগুমা ড্যাম : মাত্র 18 km. - গাড়ি'তে মিনিট চল্লিশেকের জার্নি। Murguma জলাধার'এর পোশাকি নাম। সবুজ পাহাড়ের কোলে ছবির মতো জলাধার. টিলা'র ওপর থেকে Birds' Eye View. চারপাশ শুধু সবুজ আর সবুজ ! প্রকৃতির সাথে মাখামাখি সুগভীর নির্জনতায় হারিয়ে যাওয়া নিজেতেই. শান্তি যদি পৃথিবীতে কোথাওই থাকে, তা বুঝি এখানেই। মুরগুমা জলাধারের পাড় ধরে স্বপ্নের ওই এক লাল মাটির পথ, আসমানি জল যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। কোনো কথা নয় এখন, প্রিয় মানুষ'টির হাতে হাত রেখে নিশ্চুপ শুধু অলস পদচারণা, স্বপ্নের জাল বোনা. দারুন রোম্যান্টিক এই মুরগুমা। চারপাশে সবুজের মেলা আর তারই মাঝে উঁকি মারছে দূরের পাহাড় গুলো. প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যেতে হয় ! মনে হবে, এ তো আমারই স্বপ্নের সেই জায়গা যেখানে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম বারবার। শেষ বিকেলে মুরগুমা'র বুকে সূর্যাস্ত - সে এক দারুন অভিজ্ঞতা. বিকেল একটু পড়ে এলেই শুরু হয়ে যায় রঙের খেলা, আকাশের বুকে ঘন ঘন রং বদলানো দেখতে দেখতে মনে হবে জীবনে এতো সুন্দর বিকেল আগে তো আসেনি কখনো। নেশা ধরানো সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে যায় মন. এক অন্য অনুভূতি। অন্যরকম ভালোলাগা, এই ভালোলাগার রেশ নিয়েই এবার ফেরা'র পথ ধরা।
পলাশ বিতান Jungle Huts জলাধারের পাশে প্রকৃতির সাথে মাখামাখি নির্জনতায় অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো ছেটানো সব কটেজ. রয়েছে 1 টি ডাবল বেড রুম @900/-, 1 টি ইকোনমি ট্রিপল বেড রুম @1200/- আর 5 টি ডিলাক্স ট্রিপল বেড রুম @1500/-. এই ডিলাক্স ট্রিপল বেড রুমে 5 জন পর্যন্ত থাকা যায়।
পিকনিক ট্যুরে এলেও এক'টা-দু'টো ঘর বুকিং করে রাখলে সবচেয়ে ভালো. মাঝে মধ্যে ফ্রেশ-ট্রেশ হতে হবে তো, এনার্জি রিফিলিং'র ব্যবস্থাও তো চাই । জমিয়ে দুপুরের খাবার এখানেই।আগে ভাগে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে. পুরুলিয়া'র দেশী চিকেনের কিন্তু স্বাদ'ই আলাদা।
ফিরে আসা একই ট্রেনে. মুরগুমা থেকে বিকেল 5.30'র মধ্যে রওনা দেওয়া'টা জরুরি. 49 km দূরের পুরুলিয়া স্টেশন পৌঁছুতে ম্যাক্সিমাম ঘন্টা দেড়েক। রাতের চক্রধরপুর হাওড়া ফাস্ট প্যাসেঞ্জার পুরুলিয়া ছাড়ছে রাত 8.07. হাওড়া পৌঁছয় পরদিন কাক ভোরে 4.20,
আর থেকে যেতে ইচ্ছে হলে তাও হবে. ঘরের বুকিং তো আছেই. সেক্ষেত্রে পরদিন বিকেল 3.35'এ পুরুলিয়া জংশন থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস. হাওড়া পৌঁছুচ্ছে রাত 9.15।
মাত্র দু'দিনের ছুটিতেই এক বুক অক্সিজেন রিলোড করে আবার ফিরে আসা দৈনন্দিন বৃত্তে !
পরের ছুটি'টা যেন কবে !