পুরনো শাড়ি নতুন হয়ে উঠে শীতের কাঁথায়-বঙ্গনারীর শিল্পকলা

কথায় বলে, বর্ষার ছাতা শীতের কাঁথা- এই দুই’কে হাতছাড়া উচিত নয় কখনও। যেখানেই যাওনা কেন ‘কাঁথাকানি’ সম্বল। স্বপ্ন দেখার জন্যও কাঁথা লাগে। হোক না সে ছেঁড়া। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন পর্বেই সঙ্গী কাঁথা। কাঁথা মানে ওম।

এক সময় গৃহস্থ বাড়িতে মরসুম বদলের চিহ্ন ছিল কাঁথা। শীত-বর্ষার সঙ্গী। দুর্গাপুজো ফুরলোই খোঁজ পড়ত কাঁথা-শিল্পীর। তবে তাঁরা অবশ্য বাড়িতেই থাকতেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার দরকার পড়ত না। দিনের কাজ ফুরলে, পড়ন্ত রোদে পিঠ পেতে শাড়ির সঙ্গে শাড়ি জুড়ে লেখা হত কাঁথা-কাহিনি। শাড়ি হতে হবে নরম আর পুরনো, কিন্তু তার বুনন আলগা হলে চলবে না। লম্বা সূচ আর রঙিন সুতোর ফোঁড়ে চলত কারুকাজ। মা-ঠাকুমা-দিদিমারাই মূলত বহন করতেন এই ঐতিহ্য।

কাঁথা বাংলার ঐতিহ্য। নিতান্ত ঘরোয়া কাঁথাই নকশার টানে হয়ে ওঠে রাজকীয়।  শীতের হাওয়া বইতে শুরু করলে অনেক মহল্লাতে আজও দেখা পাওয়া যায় কাঁথা-শিল্পীর। শহর কলকাতায় এ দৃশ্য দুর্লভ হলেও জেলা মফস্বলে এই ছবি খুব একটা পুরনো হয়ে যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধারা অর্থের বিনিময়ে বুনে দেন কাঁথা।

দেশীয় সংস্কৃতি তথা বাংলায় কাঁথার চল সুপ্রাচীন। পাণিনির ব্যাকরণ, রামায়ণ,মহাভারতে উল্লেখ আছে। বাংলা ভাষার আদি পর্বের চর্যা পদেও উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে কাঁথার। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত বইয়ে কাঁথার কথা পাওয়া যায়।

কাঁথা বোনার জন্য সাধারণভাবে তাঁতে বোনা পুরনো সুতির শাড়ি থেকে জমি অংশ আর পাড় আলাদা করে নেওয়া হয়। পাড় থেকে সুতো তোলা হয়। তার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে।

কাঁথার জমির অংশে বর্ডার দেওয়া হয়। তারপর ফাঁকা অংশে নানা রকম আলপনা আর ফিগার মোটিভ বোনা হয়। দক্ষ কাঁথা শিল্পীরা কাঁথা কাহিনিও ফুটিয়ে তোলেন তারপর এই নকশার উপরে ফোঁড় দেয়ার নৈপুণ্যের গুণে কাঁথায় বিচিত্র বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। নকশার সাথে মানানোর জন্য বা নতুন নকশার জন্য কাঁথার ফোঁড় ছোট বা বড় করা হয় অর্থাৎ ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য ছোট-বড় করে বৈচিত্র্য আনা হয়। ‘পাটি বা চাটাই ফোঁড়’ এবং ‘কাইত্যা ফোঁড়’ নামে সেলাইয়ের দু্টি ধরন নকশি কাঁথায় বিশেষ ব্যবহৃত হয়। এই ফোঁড় এর মাধ্যমে কাঁথাকে সম্পূর্ণ ভাবে চিত্রায়িত করা হয়।

কাঁথা সম্পূর্ণভাবে হাতে বোনা হয়। কোনওরকমভাবেই মেশিনে বুনন চলে না। কাঁথা-সেলাইয়ের নানারকম কৌশল আছে। সেলাইয়ের নামও হয় আলাদা। রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়,  বেঁকি ফোঁড়, বখেয়া, ডাল ফোঁড়, চাটাই কিংবা পাটি ফোঁড়- এমন নানা নাম। তবে বহুল প্রচলিত ‘রান’ ফোঁড়।

ব্যবহার অনুযায়ী কাঁথার নামও আলাদা-আলাদা। শুষনি কাঁথা, দস্তার খান, নকশি, বোঁচকা কাঁথা। ব্যবহার অনুযায়ী বদলে বদলে গিয়েছে নাম।

অনেক শিল্পীই কাঁথা বুনতে বসার আগে জেনে নেন কী কাজে ব্যবহার করা হবে সেই কাঁথা। সেই অনুযায়ী হয় নকশা। নকশায় ধর্ম ও লোক সংস্কৃতি ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে।

হিন্দু বিয়েতে কাঁথা উপহার দেওয়া হয়। সেই কাঁথায় সূর্য, প্রজাপতি থাকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের জায়নামাজ কাঁথায় সেভাবেই আসে চাঁদ মোটিভ। এছাড়া দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা অনুসঙ্গ ফুটিয়ে তোলা হয়।

জসীমুদ্দিনের ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ মনে পড়ে যায় এ প্রসঙ্গে। সেই কাব্য-কাহিনিতে সুঁইয়ের টানে কাঁথার বুকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল জীবনের কাহিনি। রুপাই আর সাজুর মিলন থেকে বিরহের গল্প।

 "কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে

মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে

হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে

তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।" ('নকশী কাঁথার মাঠ'; জসীম উদদীন)।

বাতিল আসলে বাতিল নয়, মায়া-ওম আর আদর দিয়ে তাকে আবার করে তোলা যায় নতুন। এই কাছে টানার সংস্কৃতি বাঙালি জাতির নিজস্ব জীবন দর্শন। একসময় বাঙালির অন্দরমহলে এই দর্শন ছিল আরও বেশি প্রবল। পুরনো শাড়ি তাই বাতিল হত না। হয়ে উঠত কাঁথা। বঙ্গনারীর নিজস্ব শিল্পকলা।

অখণ্ড বঙ্গে ঢাকা থেকে পুরুলিয়ায় ছিল কাঁথা শিল্পের চল। নিত্য ব্যবহার্য হওয়ায় ঘরে ঘরে দেখা যেত। কাঁথা তৈরি করতেন ঘরের মহিলারাই। কাঁথাবোনা ছিল তাদের অবসরের কাজ। নকশি কাঁথার আবার দুই ঘরানা ছিল যশোরের নকশি কাঁথা আর রাজশাহীর নকশি কাঁথা।

অতীতে কিন্তু কাঁথা ‘বিক্রয় পণ্য’ ছিল না। কাঁথা প্রিয়জনের উপহার। সদ্য মা হওয়া কন্যা, সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে ভালবেসে দেওয়া হত। শিশুদের কাঁথায় আবার বোনা থাকত আদরের নাম। এখন অবশ্য কাঁথা বিদেশের বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। কাঁথার প্রদর্শনীও চলে। কাঁথা সংগ্রহের সামগ্রী।

বাংলাদেশের কাঁথা গ্রামে ব্যবসাইয়িক ভিত্তিতে তৈরি হয় কাঁথা। এপার বাংলাতেও শুরু হয়েছে সেই ধরনের কর্মসূচী।

তবে এইসব সত্বেও বলতেই হয় আর মানতেই হয় যে- কাঁথা আজ লুপ্তপ্রায়। রোজকার জীবনে সেভাবে ব্যবহার দেখা যায় না। কাঁথার জায়গা নিয়েছে বালাপোশ আর ব্ল্যাঙ্কেট। তবু হারানো দিনের স্মৃতি হয়ে সে ফিরে আসে কখনও-সখনও। শীতের বারান্দায় রোদ খায় কবেকার কাঁথা।

পুরনোকে আঁকড়ে থাকার অভ্যাস কারুর কারুর থেকেই যায়... ‘বাতিল’কে সহজে ‘বাতিল’ বলে মানতে পারে না। প্রাণে ধরে ফেলতে পারেনা। বেরিয়ে আসে তারা ভাঙা টিনের তোরঙ্গ থেকে...   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...