শুভ জন্মদিন রূপম রক ইসলাম

এই একলা ঘর আমার দেশ

আমার একলা থাকার অভ্যেস

ভাবি কিছুতেই ভাববো না তোমার কথা

বোবা টেলিফোনের পাশে বসে

তবু গভীর রাতের অগভীর সিনেমায়

যদি প্রেম চায় নাটুকে বিদায়

আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি আবার

দেখি চোখ ভিজে যায় কান্নায়...

বন্ধ ঘরের ওপার থেকে ফেরে আসে গান। দরজা শক্ত করে বন্ধ। ভিতরে দেওয়াল জানলায় ধাক্কা খেয়ে গমগম করছে গান। হোম থিয়েটার নয়, মোবাইল নয়-এক ফোঁটা খুদে রেডিয়ো আর কাঠের বাক্সের সাউন্ড বক্স থেকে।

এ ঘরের যিনি মালিক তিনি সেই যে স্কুল থেকে ফিরে দুয়ার দিয়েছেন সন্ধে পেরিয়েও দরজা খোলেনি। মন খারাপ। কান্না পাচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই, তবু বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও...কবেকার হারানো আকাশে...

এ খুব চেনা ছবি। স্মৃতি হাতড়ালেই উঁকি মারে। বছরের হিসেব হবে নব্বই পেরিয়ে দুয়ের ঘরে পা রেখেছে। পৃথিবী বলছে শুরু হয়ে গেছে মিলেনিয়াম। অথচ নব্বই তখনও লেগে আছে খাতার পাতায়। স্কুলের শেষ আর কলেজের শুরু। খাতার ভিতরে লেখা প্রিয় গানের কথারা। শহরে এসেছে এফএম। খবরের কাগজে প্রতিদিন বের হয় চ্যানেল সময় আর গানের নাম। রুবি রায়, রঞ্জনা আর তোমাকে চাই পেরিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া চোখ খোঁজে ‘একলা ঘর’।

একলা ঘর, একলা দেশ- গান শুনতে শুনতে কষ্ট হয় খুব। কে গায় এমন করে। যেন মনে হয় স্কুলের মাঠে বসে আছে ঠিক পাশেই। খোঁজ চলে জোর। বন্ধুরা বলে ‘জানিস না কার গান? ছেলেটার নাম তো রূপম’।

তখনও ইন্টারনেট অধরা। শুধু বাবা-মায়ের অফিসে পাওয়া যায় টিভির মতো কম্পিউটারে। আর আছে পাড়ার সাইবার ক্যাফেতে। কিন্তু সেখানেও আছে পাহারাদারের চোখ। কোথায় পাওয়া যায় তাকে?

পাড়ার মোড়ে ক্যাসেটের দোকান-চাই একলা ঘরের গান। আচ্ছা ও তো ফসিলস। না না রূপম। ওই হল।

তারপর থেকে রোজ এক গান। রোজ এক নাম। কেন এত মন খারাপ হয়? কেন এত কান্না আসে? পরীক্ষায় মার্কশিট দেখাতে ভয় করে বাড়িতে? তার কাছেই রাখা সব সমাধান।

প্রতি মাসে সমাধান দেয় একটা ম্যাগাজিন। বাড়িতে লুকিয়ে কেনা, টিউশনের ক্লাসে কাড়াকাড়ি করে পড়া চলে ‘ফ্রাস্টু থেকে ফ্যাব’- কী করে হয়?

এতদিনে অনেকটা জেনে যাওয়া রূপমকে। রকের রাজা রূপম। ঝাঁকড়া চুল, কালো টিশার্ট, নীল জিন্স, চশমার ওপারে জ্বলজ্বলে চোখ। আর কনফিডেন্স। যেন একবার তাকালেই বদলে দিতে পারে সব। লোকটা গান গায়, ‘চক্রব্যুহে আজও, বন্দী হয়ে আছি,সে চোরাবালি আজও, গ্রাস করছে আমাকে’।

যন্ত্রণার গান গায়, কিন্তু বলে যায় ওষুধের খোঁজ। অভিমান, অপমান, রাগ, ভাঙা মন বদলে যায় একরোখা জেদে। অর্কুটের আড্ডায় খোঁজ চলে কে আছে ‘আমারই মতো’। ‘একলা ঘর’ টাইপ করে সার্চ দিলেই কত ঘর। গিটার, রূপম আর ফসিলস- কমিউনিটিতে কমিউনিটিতে ছয়লাপ...

অর্কুট যায়, ফেসবুক আসে। নেটদুনিয়ায় নতুন রূপম। একলা ঘরের ওপারে স্কুলের ছেলেটা কলেজ পেরিয়ে বিদেশ যায়, সঙ্গী হয়, হৃদয় জোড়ে, হৃদয় ভাঙে আর সেই সার্কাসে বলি হতে হতে সে বেঁচে যায়। সময় খোলনলচে বদলে দেয় তার শুধু বদলায়না সেই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা আর প্রিয় গানগুলো। আজও যুদ্ধ জয়ের সঙ্গী ফসিলস আর রূপম।

টাকি বয়েজ স্কুলের মাস্টার মশাই। বাবা নুরুল ইসলাম আর মা ছন্দ্রিতা ইসলাম। আশুতোষ কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এডের ছাত্র।

বাবা-মা দুজনেই গান করতেন। ঝংকার নামে তাঁদের একটা গানের দলও ছিল। সেই দলেই প্রথম গানের শুরু মাত্র ৪ বছর বয়সে। তারপর ঠেকে গান আর জীবন দুই জুড়ে গিয়েছিল একসঙ্গে। হাত ধরাধরি করে তারা পার করছিল সময় অসময়।

১৯৯৫-এর ১ অগাস্ট টাকি বয়েজ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। গান কিন্তু তার চলন বদলালো না। 'রিদিম', 'রিদমিক', 'হরিদাসের ডানা' এবং 'দূরের গাংচিল শেষ পর্যন্ত ফসিলস জীবন।

১৯৯৮ সালে রূপমের প্রথম সোলো অ্যালবাম 'তোর ভরসাতে' এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়। অ্যালবাম হিট না হলেও ২০০৩ সালে পুনঃপ্রকাশিত হয় অ্যালবামের গান ‘নীল রং ছিল ভীষণ প্রিয়’। ভীষণ জনপ্রিয় হয় সেই গান।

১৯৯৮ সালে বাংলা রক ব্যান্ড ফসিল্‌স-এর আত্মপ্রকাশ। ২০০২ সালে তাঁদের প্রথম অ্যালবাম 'ফসিল্‌স' আশা অডিও থেকে প্রকাশিত হয়। ২০২৩-এ ফসিলস ২৫ বছরে। রূপম প্রধান গায়ক।

তিনি বলেন প্রচারে নয়, তিনি প্রতিভায় বিশ্বাস করেন। নিজেকে বলেন ‘গান লেখার মেশিন’। তিনি গান লেখেন, কম্পোজ করেন, গানের গায়কও তিনিই। পারফেকশনের অভ্যাস পারফর্ম্যেন্সের ধার বাড়িয়েছে ফসিলস-এর।

রূপম একসঙ্গে অনেক কিছু ফসিলস-এর পারফর্ম্যার, একক শিল্পী, লেখেন, পত্রিকা সম্পাদনা, সিনেমায় সঙ্গীত করেন। নিজের শিল্পী সত্ত্বাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহুতে। কিন্তু শ্রোতাদের কাছে আজও তিনি রূপম অন দ্য রকস। যিনি ঝড়ের মতো এক বিধ্বংসী মানুষ স্টেজে। আর সম্মোহনের টান। তাঁর গান বাঁচার রসদ।

১৯৭৪-এর ২৫ জানুয়ারী এই কলকাতা শহরেই তাঁর জন্ম হয়। আজ তিনি ৪৯ বসন্তে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...