উড়িষ্যার কাশ্মীর দারিংবাড়ী অনেকদিন থেকেই মন টানছিল, হঠাৎ করেই সুযোগটা এসে গেল। কোনরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই তাই বেরিয়ে পড়া। সাহসে ভর করে কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে প্রায় ৭০০ কিমি দূরের গন্তব্যে, মাঝখানে অবশ্যই একদিনের বিরতি নিয়েছিলাম গোপালপুর অন সী তে। দীর্ঘ যাত্রাপথ বটে, তবে তাতে সৌন্দর্য্যের কোন ঘাটতি ছিলো না!
গোপালপুর থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে প্রথমে তারাতারিনী মন্দির, তারপর তপ্তপানি হয়ে দারিংবাড়ী পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোতে বড় মায়াময়ী লাগছিল ওড়িষার এই শৈলগ্রামটিকে।
ওড়িশার একমাত্র শৈলগ্রাম, কন্ধমাল জেলার দারিংবাড়ী, দারিংবাড়ীকে বলা হয় "পূর্বভারতের কাশ্মীর"। শোনা যায় শীতকালে এখানে বরফ পড়ে, আমরা যেহেতু গেছি অক্টোবরের শেষ দিকে তখন অবশ্য বরফের ছিটেফোটাও পাইনি। তবে তাপমাত্রা বেশ আরামদায়ক, একটা হালকা চাদরেই কাজ চলে যায়। বেশীরভাগই আদিবাসী অধ্যুষিত, চোখে পড়ে আদিবাসী মহিলারা মাথায় কলসী নিয়ে প্রায়ই রাস্তাপারাপাররত। এখনও ততটা শৌখিন পর্যটকপ্রবন হয়ে ওঠেনি বলেই বোধহয় দারিংবাড়ী এত নিষ্পাপভাবে সুন্দরী। এখনও দারিংবাড়ীতে সন্ধ্যা নামে হুট করে পাহাড়ের কোলে কোন এক মেষপালকের বাঁশির সুরে।
স্থানীয় দোকানে চা,বিস্কিট খেয়ে পরদিন খুব সকাল সকাল বেরিয়ে প্রথমেই দেখে নিলাম কফি প্ল্যান্টেশন,গোলমরিচ বাগান। এই সাতসকালে অনবদ্য পরিবেশে শান্ত,কোলাহলহীন গা ছমছমে বাগানের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি হেঁটে যেতে বেশ লাগছিলো। তারপর গেলাম পাইন গার্ডেন এ, এখানেও একটা আলো আঁধারী পরিবেশ, গাছেরা যেন কথা বলছিলো একে অপরের সাথে। আর তাদের বন্ধুতা মনে করাচ্ছিল আমাদের হীনতা, স্বার্থপরতার কথা, সেখানেও বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছিলাম।
তারপর অদ্ভুত সুন্দর রাস্তা, দূর থেকে জলের শব্দ, আর সেই শব্দের উৎস সন্ধানে আমরা চলেছি এক দুর্ণিবার আকর্ষনে। যাওয়ার পথটি একটু ভাঙা, রাস্তা অতটা ভালো নয়, তবে অসম্ভব সুন্দর। অবশেষে তার দেখা পেলাম, ঝরো ঝরো ধারায় সে ঝরে চলেছে, মৃদুবান্দা জলপ্রপাত। স্নান করতে না পারার দুঃখ অবশ্য পা ভিজিয়ে ভুলতে হল। এতকিছুর মাঝখানে দুপুর বেলা খাবার কথা ভুলেই গেছি।
এরপর হিল টপ ভিউ আর নেচার ক্যাম্প,একদম পাশাপাশি দুটির অবস্থান। পাহাড়ের কোলে এক সুন্দর ভিউ পয়েন্ট হিল টপভিউ,শুনেছি এখানে সূর্যাস্ত অপূর্ব লাগে, নানা রঙের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছিল শেষ বিকেলের আলোয়। বিকেলের কমলা আলোয় নেচার পার্কটির রঙ আরো খোলতাই হয়ে উঠেছিল, এক অপূর্ব আবেশে মনটা ভরিয়ে তুলেছিল, যা কখনো ভোলার নয়! শেষ বিকেলের শেষ চার্মটি ছিল লাভার্স পয়েন্ট, ডডুবরা নদী ছোট বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে এক অনিন্দ্যসুন্দর জলপ্রপাতের রূপ নিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্য্যিমামার এক টুকরো হাসি ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছিল জলের মধ্যে, আর আমরাও অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম তার এভাবে ধীরে ধীরে লুকিয়ে যাওয়া।
এবারে তো ঘরে ফেরার পালা থুড়ি হোটেলে ফেরার পালা, হাতে সময় কম থাকায় পরদিন সকালে কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হল। কিন্তু মনে খচখচানি থেকেই গেল, আবার আসব ফিরে দারিংবাড়ীকে নতুন রূপে দেখতে কোন এক অলস দুপুরে বা পড়ন্ত বিকেলে।